নাট্যজনের দায়বদ্ধতা
আমাদের নাটক আজ থেকে তিন দশক আগে শুরু হলেও অনেকেরই ধারণা যে এখনও আমাদের নাট্য চর্চার শৈশব পার হয়নি। যদিও শৈশবের দু:শ্চিন্তাহীন জীবনের প্রতি প্রলোভন কার না আছে? কিন্তু খুব বেশিদিন ঐ অবস্থায় ঝুলে থাকলে নাটক আজীবন খর্বাকৃতির থেকে যাবে এই ভয়টি অবশ্যই থাকে। কারণ আজীবন শৈশব, এক ধরনের বৈকল্যতো বটেই। কাজেই নাটকের শৈশব থেকে কৈশর এবং যৌবনে উত্তরণ ঘটতে হবে। আমরা আলোচনা-সমালোচনায় যাই বলে থাকিনা কেন, আমি বিশ্বাস করি যে এক ধরণের বয়োপ্রাপ্তি আমাদের নাটকের ক্ষেত্রে ঘটেছে। আমাদের নাট্যজনেরা নাটকের আঙ্গিকে এবং প্রতিপাদ্য নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করেছেন। আমরা নাটকে বৈচিত্র দেখতে পাচ্ছি। এই বৈচিত্রের পেছনে কিছু মানুষ এবং সম্প্রদায়ের অবদান অস্বীকার করবার উপায় নেই।
আজ থেকে এক/দেড় বছর আগে তখন আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন, প্রণম্য বুদ্ধিজীবী সরদার ফজলুল করিমের একটা লেখা পড়েছিলাম এক বহুল প্রচারিত দৈনিকে। তাঁকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র জিজ্ঞেস করেছিলেন সংস্কৃতি কর্মীর (নাকি নাট্যকর্মীর?) দায়বদ্ধতা কি? জবাবে সরদার ভাই বলেছিলেন তাঁর পক্ষে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া বড় শক্ত। জীবনই বলে দেবে দায়বদ্ধতা কি এবং কোথায়? সরদার ভাই অনেক বড় মাপের মানুষ। তাঁর পড়াশোনা এবং জ্ঞান অপরিসীম। তিনি সেদিন ঐ যুবককে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমার জীবনই আমায় বলে দিয়েছে আমার একটা দায়বদ্ধতা আছে নাটকের প্রতি এবং জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ কাটবার অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হয়ে আমি সেটা বুঝতে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি একটি শিল্প মাধ্যমের সাথে জড়িত ব্যক্তি হিসেবে এই দায়বদ্ধতা আরও একটু গভীর। আমি যখন ঐ যুবকের বয়সী ছিলাম তখন এই প্রশ্নটি আমাকে তত চিন্তান্বিত করেনি।
এখন কয়েকটি প্রশ্ন দিয়ে আমি ফিরে যেতে চাই মূল প্রসঙ্গে। আমরা যখন দায়বদ্ধতার কথা বলি তখন আমরা কার কাছে দায়বদ্ধতার কথা বোঝাতে চাই? পরিবারের কাছে? সমাজের কাছে? রাষ্ট্রের কাছে? এই দায়বদ্ধতাগুলো সর্বজনীন। যে কোন দেশের, যে কোন সমাজের, যে কোন রাষ্ট্রের মানুষেরই এই দায়বদ্ধতাগুলো আছে। কিন্তু শিল্পকলার কর্মীর দায়বদ্ধতার কথা বললে একটা চতুর্থ মাত্রা যুক্ত হয় এই প্রশ্নের সাথে। সেটি হ’ল শিল্পকর্মের প্রতি দায়বদ্ধতা।
আমি এই আলোচনার সুচনায় বলেছিলাম আমরা নাট্যকর্মে বয়োপ্রাপ্ত হচ্ছি। বলেছিলাম এই কারণে যে আমাদের পরিচিত নাট্য বিশেষজ্ঞরা ক্রমে তাঁদের চর্চিত নাটককে একটা স্বকীয় চরিত্র দেবার চেষ্টা করছেন। আমরা প্রতি নিয়ত আমাদের নাটকে নতুন, নতুন সংযোজন দেখছি। কেউ ন্যারেটিভ থিয়েটারের কথা বলছেন, কেউ এনভারন্মেন্টাল থিয়েটার নিয়ে বলছেন; কেউ কেউ বলছেন রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। আবার কেউ বলছেন শেক্সপীয়র কোন নাট্যকারই নন। এই রকম নানা জন নানা কথা বলছেন। তবে আশার কথা এই যে, নাটক নিয়ে একধরণের আন্দোলন হচ্ছে। এটা অত্যন্ত আনন্দের কথা। যে কোন চলমান শিল্পকলার ক্ষেত্রেই এই গতি পরিলক্ষীত হয়।
আমরা জানি যে নাট্যদলগুলো যেমন নাট্যচর্চাকে গভীরভাবে ভালবাসেন তেমনি তাঁদের নাটক আরও জনপ্রিয় হোক এটাও তাঁরা চান। কেননা নাটকতো দ্বিজ শিল্পকর্ম। লেখায় যার শুরু, অভিনয়ে যার সম্পূর্ণতা। এই অভিনয়তো ফাঁকা মিলনায়তনে করে লাভ নেই। দর্শকই যদি না দেখে তবে নাটক সম্পূর্ণতা পায় কিভাবে? এটা যদি নাটক চর্চার একটি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে যে আমরা আমাদের কাজ দর্শকদের দেখাবো, আরও অধিক হারে দর্শকদের দেখাবো, তাহ’লে নিশ্চয়ই এটা নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে এবং এটা নিয়ে কেবল ভাবলে চলবে না, এ’সম্বন্ধে কোমর বেঁধে কাজে নামতে হবে। কেননা আমাদের দায়বদ্ধতা বড় কঠিন এক দায়বদ্ধতা। আমাদেরকে একাধারে ভাল নাটক করতে হবে, অর্থাৎ শিল্পগুণ সম্পন্ন নাটক, আবার একই সাথে সেই নাটকে জনসমাগম ঘটাতে হবে।
এই দু’টি দায়িত্বের সমন্বয় সাধন করতে কি আমরা পারছি? আমি নিশ্চিত যে বুকে হাত দিয়ে এই কথার নিখাঁদ সত্য জবাব হবে আমরা ভাল নাটক এবং জনপ্রিয়তার সমন্বয় সাধনে বিফল হচ্ছি। হাতে গোনা কয়েকটি দলের কিছু ভাল নাটকে হয়তো জনসমাগম হচ্ছে। কিন্তু তা খুবই কম। এত কালেভদ্রে এই ঘটনাটি ঘটছে যে মঞ্চনাটককে পেশা হিসেবে বিবেচনা করারও সময় এখনও আসেনি। আমাদের ভাগ্য ভাল যে এখন প্রচুর টেলিভিশন নাটক হচ্ছে, বিশেষ করে নতুন; নতুন চ্যানেলগুলোর জন্যে। এই প্রাইভেট প্রোডাকশনের কল্যানে নাট্যজনেরা, অনেকেই কেবল নাটক করে কোন প্রকারে গ্রাসাচ্ছাদনের উপায় করছেন। কিন্তু এই টেনে আনতে ছিঁড়ে যায় ব্যবস্থায় কতদিন তাঁরা চালিয়ে যেতে পারবেন সেটাও ভেবে দেখবার বিষয় বৈকি। আবার এমনও হচ্ছে যে অভিনয় করে খাওয়া পরার ব্যবস্থা করতে গিয়ে মঞ্চ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এই যে এত বাধা, প্রতিনিয়ত এত ধরণের বিপত্তি এ’ নিয়ে যে কিছু মানুষ এখনও একাদিক্রমে বছরের পর বছর নাটক করে চলছে এটাই বা কম কিসে? এ’ কারণে সাধুবাধ তাঁদের অবশ্য প্রাপ্য।
তবুও কিছু কথা থেকে যায়। শিল্পকর্ম এবং নাটকের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থেকেই নির্ধারিত হবে সংস্কৃতিজন হিসেবে আমাদের অবস্থান। দুঃখের বিষয় হ’ল এই যে, স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের নাটকের ওপর একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এটি হচ্ছে রাজনীতির সাথে আমাদের সম্পৃক্ততা। আমি আদৌ এ’কথা বলতে চাইছিনা যে সংস্কৃতিজনের রাজনৈতিক বিশ্বাস-সচেতনতা থাকবে না। সংস্কৃতিবান মানুষ মাত্রেই রাজনীতি সচেতন হবে। কিন্তু তাঁর বিষয়বস্তুতে, প্রাত্যহিক কর্মকান্ডে, যদি সবসময় রাজনীতি প্রাধান্য পায় তবে শিল্পকর্মের প্রতি অবিচার করা হবে। আমি আমার কোন একটি লেখায় বলেছিলাম যে সৃজনশীল কর্মে যাঁরা ব্যাপৃত তাঁদের নিজেদেরকেই চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁদের সংস্কৃতি চর্চায় রাজনীতির অবস্থান হবে কোথায়? সংস্কৃতিজনের জন্য কোথায় রাজনীতির ‘অন্ত’ এবং শিল্পচর্চার ‘আদি’ এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনতি না হতে পারলে শিল্পকর্মের মান ব্যাহত হবে এবং আমাদের দায়বদ্ধতার প্রতি আমরা অনুগত থাকতে পারবো না।
আমাদের দু’টি সত্ত¡া, শিল্পী সত্ত¡া এবং রাজনৈতিক তথা সামাজিক সত্ত¡া এর মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করা দরকার। কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের কারণে আমাদের এখানে একাধিক নাটক রচিত এবং অভিনীত হয়েছে। এইসব নাটকের মধ্যে কয়েকটি জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। কিন্তু শিল্পকর্ম হিসেবে সেগুলো কোন জায়গাতেই ঠাঁই পায় না। জনপ্রিয় কাজ মানেই যে শিল্পসম্মত কাজ তাতো নয়? ¯ø্যাপস্টিক কমেডিওতো জনপ্রিয় হতে পারে। কিন্তু তাকেতো আমরা সৃজনশীল শিল্পকর্ম অভিধায় চিহ্নিত করতে পারি না।
দায়বদ্ধতার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এক কথায় বোধ হয় বলা যায় যে, আমাদের শিল্পসৃষ্টির প্রতি সততা এবং একাগ্রতাই হচ্ছে আমাদের দায়বদ্ধতা।