টিভি নাটকে নারী

 

আমার ইচ্ছে, সামগ্রিক বাংলা সং®কৃতির আলোকে বাংলাদেশের টিভি নাটকে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য সম্পর্কে কথা বলা। তবে শুরুর আগে আমি গল্পের মুখবন্ধের মতোই একটু ভূমিকা রাখতে চাই। আমরা যদি বাংলাদেশের সৃজনশীল কর্মকান্ডের দিকে তাকাই ধ­য দেখতে ভ¡­য¡ একটি পুরুষ শাসিত সমাজের অবয়ব। এই অবয়বটা আমাদের পূর্ব পুরুষরা অতীতে দেখেছেন, এখনঔ আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা যদি বাংলার সব চেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা ধরি, তার উপন্যাসেও আমরা দেখি চরিত্রের বিচারে মেয়েরা সেকেন্ডারি এলিমেন্ট, পুরুষরাই একমাত্র প্রাইমারি এলিমেন্ট। যেখানে নারীকে তুলে ধরা হয়েছে সুন্দরী, সেবিকা এবং সতী-সাধ্বী হিসেবে। বলা বাহুল্য এর সবই পুরুষের জন্য। ®শঢ়য ব¡£ পড়তে জানতেন, তারাঔ শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পড়ে কেঁদেছেন এবং হেসেছেন। কিন্তু শরৎ সাহিত্য যে বিস্তর লিঙ্গ বৈষম্যে জর্জরিত তা এরা কেউই উপলব্ধি করতে পারেননি। আমরা কিন্তু এখনও শরৎ সাহিত্য বা সামন্ত যুগের সেই অবস্থা থেকে খুব একটা বেরিয়ে আসতে পারিনি। পরিবর্তন যেটুকু হয়েছে তা খুবই সামান্য এর প্রধান কারণ, আমাদের সমাজ এখনও পুরুষ শাসিত।

আমি যদি মঞ্চ নাটকের দিকে তাকাই, আমি যদি সাংস্কৃতিক জোটের দিকে তাকাই, আবৃতি সমন্বয় পরিষদের দিকে তাকাই দেখবো এসব জায়গাগুলোতেও লৈঙ্গিক রাজনীতির আলামত স্পষ্ট। এবার আসি এসব সংগঠনের নেতৃত্বের প্রসংগে। আমরা কতিপয় লোক নেতৃত্বের জায়গাটা আগলে ধরে রাখি। আমরা কখনওই দেখতে চেষ্টা করি না, আমাদের যে সাংস্কৃতিক দলগুলো আছে, এখানে অনেক নারী আছেন, ঐঁ­পষ মধ্যে কোয়ালিটি অব লিডারশিপটা কার মধ্যে আছে। আমাদের পুরুষ বন্ধুরা বলেন, মেয়েরা কেন এগিয়ে আসে না! আমি বলব মেয়েদের পক্ষে এগিয়ে আসা সহজ নয়। সে এক বিশাল যুদ্ধ। সমুদ্রে সাঁতার কাটার মতো। আমি বলব, পুরুষ যা কিছু অর্জন করে থাকে তার অর্ধেকটাই সে পেয়ে থাকে জন্মগতভাবে, পুরুষ হিসেবে জন্মাবার ফলে। সেই সুবাদে জগতের যাবতীয় জায়গাগুলোও তাদের দখলে। যা পুরুষ বিনা যুদ্ধে কোনও মতেই ছেড়ে দিতে রাজি নয়। অন্যদিকে নারী আসে শুন্য হাতে। এ অবস্থায় পুরুষ সহযাত্রী হয়ে যদি সাহায্যের হাত প্রসারিত না করে তবে নারীর পক্ষে একা এগিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।

টেলিভিশন মাধ্যমে, নারীর প্রতি বৈষম্যের যে প্রতিচ্ছবিটা ফুটে ওঠে তা আমাদের সামগ্রিক সমাজেরই ছবি। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে বাংলাদেশে টেলিভিশন সংস্কৃতির শুরুর দিন থেকে আজ পর্যন্ত ক’টা নাটক আমরা দেখেছি, যার নাম ভূমিকা বা মূল ভূমিকাটা একজন নারীর ? আমিতো ‘করিমন বেওয়া’ বা অন্য দু’একটি নাটক ছাড়া কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। এবং অবস্থা বদলাবে না যতোক্ষন না আমাদের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি হয়। টেলিভিশন আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছন্ন কোনও মাধ্যম নয়। টেলিভিশন হলো সমাজের প্রতিবিম্ব।

আমরা যদি বাংলাদেশের উৎপাদন কর্মকান্ডের দিকে তাকাই। দেখা যাবে ষাট শতাংশেরও বেশি ভূমিকা রাখছে নারী। জমিতে লাঙ্গল দেয়া থেকে শুরু করে মই দেয়া, ধান মাড়াই, ধান সেদ্ধ করা, ধান শুকোনো —-সব কাজই করে। একই সাথে তারা কিন্তু গৃহ কর্ম থেকেও বিচ্যুত নয়। তিন বেলা রান্না করতে হচ্ছে, স্বামীকে সময় মতো খাবার দিতে হচ্ছে, হাঁস মুরগীর খোয়াড়ের দরজা খুলে দিতে হচ্ছে, তাদেরকে খাবার দিতে হচ্ছে, বাচ্চাকে গোসল করাতে হচ্ছে, তাকে স্কুলে পাঠাতে হচ্ছে, এমন কি বাচ্চার টিকা দেয়ার তারিখটাও মাকে মনে রাখতে হয়। এই যে ঘটনা, এটার প্রতিচ্ছবি কিন্তু আমরা বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখতে পাই না । হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন বা অন্য যারা আমাদের এখানে টিভি নাটক লেখেন, ধু¡­পষ নাটকেও মেয়েদের এই ভূমিকাই দেখা যায়। শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে এ-ক-টু হয়তো বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। এই আগে বাড়াটুকু বাদ দিলে বাকিটুকু তারা শরৎ চন্দ্র’তেই রয়ে গেছেন।

এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্টুডিওতে গিয়ে অভিনয় করি না প্রায় দশ বছর হতে চলল। যখন করতাম তখন দেখেছি, একমাত্র বড় মাপের নারী শিল্পী ছাড়া ছোট-খাট মাপের নারী শিল্পী যারা ছিলেন তাদের প্রতি এক ধরনের বৈষম্য মূলক আচরণ ফ্লোরের লোকজনই করত। এটা এখনও অব্যাহত আছে কিনা জানিনা। এখন প্যাকেজের আওতায় যে সব নাটক হয় সে সব জায়গায় অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে মেযেদের লক্ষ্য করে আশপাশ থেকে কথার বাণ কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি। যেমন- নারী শিল্পী যদি অনেক রাতে তার কাজ শেষ করে একা সেট থেকে বিদায় নেন, তখন অনেকে বলে থাকেন, মেয়েটি ভাল না। অপরাধ নারীটি পুরুষের কোনও রকম সাহায্য ছাড়াই একা গমন করেছেন। একই সেট থেকে যদি নারীটি তার কোনও পুরুষ বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন, সেখানেও সহকর্মীরা রহস্যের সন্ধান করে বেড়ান। এক্ষেত্রে নারীটির অপরাধ তিনি একটি পুরুষ মানুষের সঙ্গে অবস্থান ত্যাগ করেছেন। আর পুরুষ যখন কোনও নারীকে নিয়ে সেট থেকে বেরিয়ে যান সেখানে কিন্তু ভ¤ষ¦ড়¢ঠষ ল­ফণ্ঠ কোনও রকম রহস্যের গন্ধকে খ¤ুজে পান না।

আমাদের পত্র-পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গীও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর চেয়ে খুব একটা উন্নততর নয়। দৈবাৎ কোনও নারী শিল্পী যদি লাঞ্চিত হন, সেই খবরটিকে পত্রিকাগুলো অত্যন্ত মুখরোচক করে পরিবেশন করে। যা থেকে পাঠক এক ধরনের জৈবিক সুড়সুড়ি পেয়ে থাকে। অথচ একই ঘটনার সাথে একটি পুরুষ চরিত্রও জড়িয়ে আছে। বলা বাহুল্য, সেই চরিত্রটি পত্রিকাওয়ালাদের কাছে পুত-পবিত্রই থেকে যায়। আশার কথা এই যে, টিভি মাধ্যমে এত সীমাবদ্ধতার মাঝেও কিছু নারী তাদের শিক্ষা, সচেতনতা, শিল্পের প্রতি ভালবাসা এবং সততা- এ সবের কারণে নেতৃত্বগুণ অর্জন করতে পেরেছে।

 

আজকাল অনেকেই ‘জেন্ডার সেনসিটিভিটি’ নিয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করেন। তারা ‘লৈঙ্গিক রাজনীতি’ ‘লিঙ্গ ভিত্তিক নির্যাতন’ থেকে শুরু করে একবারে নারী সমাজের উত্তরণের বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন। আমি মনে করি এই সমস্যা থেকে রাতারাতি উত্তরণের কোনও উপায় নেই। যদিও আমাদের অনেক নারী নেত্রী মনে করেন, এ সমস্যা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি না। আমি যুক্তরাষ্ট্রে লিঙ্গ ভিত্তিক নির্যাতনের আরও একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সেটা হলো- যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ছয় মিনিটে একজন নারী ধর্ষিতা হন, প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একজন নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৩৪ জন জীবনে অন্তত একবার যৌন নির্যাতনের শিকার হন। এ তো গেলো আমেরিকার সামাজিক চিত্র। রাজনৈতিক চিত্রের দিকে যদি তাকাই কি দেখি? সেখানে নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে একজন নারীর অংশগ্রহণ আমরা তো পরে ভাববো, খোদ আমেরিকানরাও ভাবতে পারে না। তাহলে আমরা কি করে ভাবতে পারি যে আমাদের মতো একটি পশ্চাৎপদ জনপদে রাত পেরুলেই আমরা যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবো ?

তবে এ সমস্যার সমাধানে যারা কাজ করে যাচ্ছেন, যারা নেতৃস্থানীয়, যারা দেশের তাবৎ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডর ধারক-বাহক তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা সচেতনভাবে এগিয়ে এসে সহযাত্রীর মানসিকতা নিয়ে নারীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সিভিল সোসাইটিকে। একমাত্র সিভিল সোসাইটিই পারে নারীকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। এবং সিভিল সোসাইটির অংশগ্রহণের মাধ্যমেই আমার মনে হয় আমরা আমাদের সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডকে জেন্ডারের প্রেক্ষিতে সংজ্ঞায়িত করতে পারবো। এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জেন্ডার ইস্যুকে প্রাধান্য দিতে শিখব।