” জীবন গিেেয়ছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার”
আমি একেক সময় অবাক বিস্ময়ে ভাবি কীর্তিমান লেখকেরা কি করে পাতার পর পাতা লিখে যান অবলীলায়! যেন বহমান নদীর জলধারার মত। তরতরিয়ে চলে দিনের পর দিন। পন্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন গঙ্গা নদীর কথা। এক অসাধারণ বর্ণনা ছিলো সেটি। তিনি বলেছিলেন, কেমন করে গঙ্গা ভারতের দীর্ঘ ইতিহাসকে তার বুকে ধরে সেই সুদূর অতীত থেকে বয়ে নিয়ে চলেছে সযতনে বর্তমান হয়ে অজানা ভবিষ্যতের পথে। সেই বর্ণনা পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলাম। বস্তুতপক্ষে, এই সকল ক্ষণজন্মা মানুষ, পন্ডিত নেহরু যেমন, কত অনায়াসে বলতে পারেন নিজের কথা। আর আমরা ভাবতে ভাবতে ব্যাকুল হয়ে উঠি কি লিখব আর কি লিখব না। তবু ২০২০ এর প্রারম্ভে এসে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
আজ থেকে ২০ বছর আগে ২০০০ সালে এক দুর্লভ ঘটনার সাক্ষী হবার সৌভাগ্য হয়েছিলো। আর তা হলো একটি শতাব্দীকে অতীত করে নতুন একটি শতাব্দীর শুভ সূচনা প্রত্যক্ষ করবার ঘটনা। বিগত শতাব্দীটি ছিলো সেই শতাব্দী যে শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছেছিলো। যে শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথের মতো একজন সম্পূর্ণ মানুষ বাংলার আকাশ সৃজনশীলতার উজ্জ্বল আলোয় ভরে রেখেছিলেন। যে শতাব্দীতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাঙালি এক গৌরবজনক ভ‚মিকা পালন করেছিল এবং পরবর্তীতে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধে জয়লাভ করে। ভাবতে আশ্চর্য লাগছে, যে নতুন শতাব্দীকে বরণ করেছিলাম নতুন আশা আর আনন্দের সাথে সেই নতুন শতাব্দীর দুইটি দশক পার হয়ে গেলো! দুই দশক অর্থাৎ কুড়ি বছর। জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন তাঁর কবিতায়, কুড়ি বছর পেরিয়ে যাবার কথা। চরণটা বোধহয় ছিল এই রকম: ” জীবন গিেেয়ছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার।
তখন হঠাৎ যদি দেখা হয় তোমার আমার . . . . . ..।”
এই কথাগুলোতে দুটি বিষয়ে ভাবার মতো উপাদান আমরা খুঁজে পাই। একটা হচ্ছে সময় সংক্রান্ত। কুড়ি বছর! মেলা বছর! খেলা কথা নয়। এই সময়ের বিষয়টি, মনের ভেতরে কেমন যেন হাহাকার সৃষ্টি করে। মনটা আর্দ্র হয়ে আসে। আবার পরক্ষণেই এই দুঃখ ভারাক্রান্ত মনকে উদ্দীপিত করে তোলে এর পরের বাক্যটি, ”তখন হঠাৎ যদি দেখা হয় তোমার আমার!” সব মিলিয়ে আমার পড়া সকল কবিতার মধ্যে এই রকম কাব্যময় কথা খুব কমই পড়েছি আমি। পড়লেও স্মরণে রাখতে পারিনি। মানুষের জীবনে আশাহীন অন্ধকার সময় অবশ্যই আসে। এবং তা যে একবার আসে তা নয়। আমি নিশ্চিত, যে আমাদের সকলের জীবনেই বেশ কয়েকবার আসে। তবুও হঠাৎ দেখার মতো আনন্দদায়ক কোন একটি মুহূর্তের অপেক্ষায় আমরা অবলীলায় কাটিয়ে দিই কয়েক দশকের জীবন।
আমার জীবনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে নাটক। আমার নাট্য জীবনের ৪৭ বছর পেরিয়ে গেল চোখের পলকে। বহুবছর ধরেই আমার সন্ধ্যাগুলো আর আমার নিজের ছিলো না। উৎসর্গ করেছিলাম নাটকে। দিনের বেলা বিজ্ঞাপন এজেন্সীর কাজকর্ম যাতে করে জীবিকা নির্বাহ হয় আর সন্ধ্যায় নাটক। এটাইতো ছিলো আমার জীবন! আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আমার কাছে হয়ে গিয়েছিলেন গৌণ। আমার কাজকর্ম আর নাটকই ছিলো মূখ্য। আমি এ নিয়ে অনেক ভেবেছি। মনে হয়েছে যেন আমার পরিচিত সবার থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আমি। মাঝে মধ্যে খারাপ লেগেছে কিন্তু তবুও জীবনের ধারাকে বদলাতে চেষ্টা করিনি। এই জন্যে আমার মনে কোন দুঃখবোধ নেই। এইসব কথা বলতে পারলে যেমন নিজের কাছে ভালো লাগে তেমনি হয়তো এই কথাগুলো ভালো লাগবে নাটকের অঙ্গঁনে নতুন আসা সেইসব তরুণ তরুণীদের যাদের সাথে কাজ করার সুযোগ আমি কখনও পাবোনা । এই শেষ বয়সে এসে আমার কখনও মনে হয়না আমি ভুল পথে পথ হেঁটেছি। আমি ক্রমাগত হেঁটে চলেছি সৃজনশীলতার পথেই । দেশে নিয়মিত ভিত্তিতে নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে। বেশ কিছু বুদ্ধিমান এবং সৎ তরুণ এগিয়ে এসেছে এই কাজে। নাটক নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হচ্ছে, সেখানে আলোচিত হচ্ছে নাট্যপ্রবাহ। এর চেয়ে বেশি কিছু তো কখনই চাইনি এই জীবনে!
রবীন্দ্রনাথ তার এক কবিতায় নায়িকার কথা হিসেবে বলেছিলেন, ”রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।” আমার গোটা জীবনটাইতো প্রায় কেটে গেছে দিনের আলোর গভীরে রাতের তারা ফোটাতে ফোটাতে। কথাটার তাৎপর্য এইখানে যে আমাদের দিন ফুরিয়ে রাত্রি যখন আসবে তখন আকাশের তারাগুলো একে, একে ফুটে উঠবে। তখন হয়তো আমাদের অনাগত নাট্যপ্রজন্ম সেইসব তারা দেখিয়ে বলবে, “ঐ যে, ঐ তারাটা সৎমানুষ! ঐটা নূরলদীন, রক্তকরবী ঐ যে, ঐতো গ্যালিলিও, গডোর প্রতীক্ষায়তো ঐ ঐখানে!” এই আনন্দের মাঝেই আমি আমার সাত দশকের পথচলার অর্থ খুঁজে পাই। আমার সকল পাঠকের প্রতি রইল নতুন গ্রেগোরিয়ান বছরের জন্যে শুভ কামনা!
(সন : ২০২০)