স্বাধীনতার অংগীকার
১৯৭১ এর ৩রা মার্চ। সমগ্র বাংলাদেশ তখন উত্তাল। খবর এলো যে, জাতীয় সংসদের অধিবেশন বাতিল করা হয়েছে। সেদিন ঢাকায় স্টেডিয়ামে, পাকিস্তান বনাম এমসিসি বা কমনওয়েলথ দলের মধ্যে একটা ক্রিকেট খেলা চলছিল। জাতীয় সংসদের অধিবেশন বাতিলের খবর স্টেডিয়ামে পৌঁছামাত্র ক্রিকেটে মগ্ন বাংলার মানুষ গর্জে উঠলো। বন্ধ হয়ে গেল খেলা। মুহুর্মুহু স্লোগান শুরু হলো ’বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো – বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ….. জয় বাংলা…’। স্টেডিয়ামের সামিয়ানায় আগুন ধরিয়ে দিলো বিক্ষুব্ধ জনতা। ঐদিনই বিকেলে পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিশাল জনসভায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজ পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হলো। বাংলাদেশের মানুষ সেই দিন থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে অবতীর্ণ হ’ল। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে একটা সমান্তরাল সরকার চলতে থাকলো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে।
মার্চের শুরু থেকেই বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ শহীদ মিনারে প্রতি সন্ধ্যায় দেশাত্মবোধক গান, নৃত্য, কবিতা ও নাটকের আয়োজন করতো। আমরা ৫-৬ জন বন্ধু শহীদ মিনারের ঠিক উল্টো দিকে আমাদের পুরনো আড্ডাস্থল বেনুর ঘরে সমবেত হতাম, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উত্তেজিত কথাবার্তা হতো। ৭ই মার্চ অপরাহ্ণে বঙ্গবন্ধু তৎকালীণ রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ, লক্ষ মানুষের সামনে হাজির হলেন। তারপর সেই অবিনশ্বর আহবান, ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাক্যহীন হয়ে পড়লাম। রেসকোর্সের সকল মানুষ ফেটে পড়লো ¯¯ স্লোগানে স্লোগানে । বাতাসে স্বাধীনতার গন্ধ পেলাম যেন।
আমরা বুঝতে পারছিলাম যে পাকিস্তানীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেতে গেলে যুদ্ধ অনিবার্য। অতএব সম্মুখ সমরের প্রস্তুতি দরকার, প্রয়োজন অস্ত্রের। এমন সময় আমাদের পরিচিত একজন বললেন যে তার এক বন্ধু আছে যে হাতবোমা তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। তখন সেই বোমা প্রস্তুতকারী তরুণের সাথে আমরা যোগাযোগ করলাম। সে আমাদের বললো নেগেটিভ এবং পজিটিভ তারের ঘর্ষণের মাধ্যমে ফাটানো সম্ভব এমন বড় ধরণের এক্সপ্লোসিভ সে আমাদের তৈরি করে দিতে পারবে। আমরা চাঁদা তুলে তাকে এক্সপ্লোসিভ তৈরির কাজে নিয়োজিত করলাম। কিছুদিনের মধ্যেই এক্সপ্লোসিভটি রাতের অন্ধকারে আমাদের হাতে এলো। যে রাতে হাতে পেলাম, সিদ্ধান্ত নিলাম সেই রাতেই পরীক্ষা করে দেখবো আমরা। তখন রাত বারোটা/একটা হবে, আমরা সবাই মিলে আমার ভাঙাচোরা ফোক্স ওয়াগেন গাড়ীতে উঠে বসলাম। অতি যত্নে বিস্ফোরক কোলের ওপর রাখা। ফুলার রোডে একটি জায়গায় একটি ইস্পাতের তৈরী পরিত্যাক্ত পানির ট্যাংক খুঁজে পেলাম। বাতিল করা ঐ পানির ট্যাংক দিয়ে ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা করেছিলো ছাত্ররা। আমরা চুপিসারে ঐ পানির ট্যাংকের ভেতরে এক্সপ্লোসিভটি স্থাপন করলাম। তারপর বোমার সাথে সংযুক্ত তার দুটো নিয়ে দূরে চলে গেলাম। গাড়ীটাও সরিয়ে নেয়া হলো দূরে। তারপর, তারের নেগেটিভ-পজিটিভের একটি ঘর্ষণেই বিকট শব্দে ফেটে গেলো বোমা। আমরা কছে এসে দেখলাম পানির ট্যাংকটি ফেটে চৌচির। আমাদের মনে আনন্দ আর ধরে না।
২৫শে মার্চ, সেদিন সন্ধ্যা থেকে ধারাবহিকভাবে দেশাত্মবোধক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল ভাষা শহীদ মিনারে। হঠাৎ রাত সাড়ে ৯ টার দিকে ঐ অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। চারদিকে কেমন যেন একধরনের ভৌতিক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিলো। আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম শহীদ মিনার অন্ধকার, কোথাও কেউ নেই। ঐ ভবনের ক্যাফেটেরিয়ার মালিক বলাই আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, ‘‘মনে হয় অবস্থা খুব ভাল না। আপনারা বাড়ি চইলা যান।” আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আসলে কী ঘটছে জানার জন্য আমরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে, বঙ্গবন্ধু ভবনে যাব। গাড়ি করে যখন রোকেয়া হলের সামনে এসেছি তখন দেখতে পেলাম যে রোকেয়া হলের সামনে সদ্য ফেলে রাখা একটি বিশাল শিরিষ বৃক্ষ কেটে সাফ করা হচ্ছে। এই বৃক্ষটি ওখানে রাখা হয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যাত্রাপথে ব্যারিকেড দেবার জন্য। ডানে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে ২ ট্রাক ভর্তি অস্ত্রসজ্জিত সেনা সদস্য উপস্থিত। আমরা একটু অবাকই হলাম। ৩২ নম্বরে যখন পৌঁছলাম তখন চারিদিক সুনসান। গেটে কেবল একজন দ্বাররক্ষী দাঁড়িয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন যে আওয়ামী লীগের সকল শীর্ষ নেতা কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলে গেছেন তাদের গন্তব্যে। পাকিস্তানের সঙ্গে সংলাপ বিফল হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি এও বললেন, ‘‘আপনারা যার যার বাড়িতে চলে যান। কেননা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার রাস্তায় নামবে।” আমরা গাড়ি করে তড়িঘড়ি মগবাজারে এলাম। কেননা সেখানেই আমাদের চারজনের গন্তব্য ছিল। তাদেরকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে আমি একা গাড়ি চালিয়ে রাজারবাগে আমাদের বাসস্থানে গিয়ে পৌঁছলাম।
রাত তখন পৌনে এগারটা হবে। হাত মুখ ধুয়ে কেবল খেতে বসেছি। এমন সময় সামনের রাস্তা থেকে একটা হৈচৈ এর শব্দ পেলাম। আমি খাওয়া ছেড়ে উঠে দ্রুত হাত ধুয়ে দৌড়ে গেলাম রাজারবাগের সামনের সদর রাস্তায়, যেটি আমার বাড়ি থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে ছিল। গিয়ে দেখি সেখানে পাড়ার সকল লোকজন জড়ো হয়েছে। তারা সবাই উত্তেজিত। কেউ কেউ ‘জয়বাংলা’ বলে ¯ স্লোগান দিচ্ছে। রাজারবাগে যেসব পুলিশ ভাইরা থাকতেন তাঁরা রাইফেল হাতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন এবং সকলকে বোঝাচ্ছেন নিজ, নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে। কেননা নিরস্ত্র মানুষ রাস্তায় থাকলে পাকিস্তানিরা তাদেরকে মেরে ফেলবে আর তাতে করে পুলিশের পক্ষে প্রতিরোধ বুহ্য রচনা করা প্রায় অসাধ্য হয়ে পড়বে। তাঁরা এও বললেন যে, শেষ বুলেটটি থাকা পর্যন্ত এবং তাঁদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ে যাবেন। আমরা যার যার বাসায় ফিরে এলাম। মিনিট কয়েকের মধ্যে পাকিস্তানের ক্ষুদ্র ও ভারী অস্ত্রের গুলির শব্দ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। সেগুলোর নিশানা ছিল রাজারবাগের পুলিশ লাইন। মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ হচ্ছিল।
আমি অতি সাবধানে বাড়ির ছাদের ওপরে উঠে গেলাম। সেখানে ছাদের রেলিংয়ের আড়াল থেকে আমরা রাজারবাগের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশ দিয়ে অসংখ্য ট্রেসার বুলেট ভেসে যাচ্ছে। আকাশের তারা ম্লান হয়ে গেছে যেন। আর ভারী গোলার ভূ-পতিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আগুনের হলকা উঠছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের স্থাপনাগুলো থেকে। ভোর সাড়ে ৪টা কি ৫টা হবে। গোলাগুলির শব্দ স্তিমিত হয়ে এসেছে এমন সময় আমাদের সদর দরজায় হালকাভাবে কয়েকটি টোকার শব্দ পেলাম। দরজার পেছন থেকে পরিচয় জিজ্ঞেস করায় বাইরে থেকে জবাব এল, ‘‘আমরা পুলিশ, ভাই।” আমি দরজা খুলতেই দেখলাম সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন প্রায় উলঙ্গ মানুষ। দুজনেই মালকোচা করে লুঙ্গি পরে আছেন। তাদের মধ্যে একজন আমায় বললেন, ‘‘ভাই আমাদের বুলেট শেষ। আমাদের অনেক বীর সহকর্মী আত্মদান করেছেন এই যুদ্ধে। এই রাইফেল দুটো আপনি নিন। কোথাও লুকিয়ে ফেলবেন যেন পাকিস্তান দখলদার বাহিনী এগুলো খুঁজে না পায়। আমরা চলে যাচ্ছি। কোথায়, জানিনা। তবে আমরা আবার ফিরে আসবো এবং যুদ্ধ করে আমাদের দেশ স্বাধীন করব ইনশাআল্লাহ । জয় বাংলা।” এই বলে তাঁরা অন্ধকারে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলেন। আমি সেই খোলা দরজার সামনে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। সম্বিৎ যখন ফিরল তখন ভাবলাম একটি কর্ম তখনও বাকি আছে। রাইফেল দুটোকে কাঁধে করে অন্ধকারের মধ্যে আমাদের গলিতে দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে বাড়ির পেছনের জলাভূমিতে রাইফেল দুটোকে বিসর্জন দিলাম। তারপর কি হলো জানিনা। চোখ বেয়ে এল বাঁধভাঙা কান্না। হাঁটু গেড়ে ঐ জলার পাশে বসে পড়লাম। পুব দিক যখন ফর্সা হয়ে এল, সুদূর কোথাও থেকে ভেসে এল আযানের আওয়াজ। আমার হৃদয়ে তখন এক নতুন প্রত্যয় জন্ম নিল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে সত্তর এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। হাত মেলাতে হবে তাদের সঙ্গে যারা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশের স্বাধীনতা অর্জনের অঙ্গীকার করেছে। তারপর বিজয়ীর বেশে একদিন ফিরব আমার এই প্রিয় শহরে। ফিরবই ।
উৎসঃ সেই অরুণোদয় থেকে