অবশেষে নিজভূমে
১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১। কাজ শেষ করে বেনাপোল পার হয়ে আমি যশোর রোডের ওপরে এসে দাঁড়িয়েছি। যশোর রোডে যদি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোন গাড়ির দেখা মেলে তাহলে সেটাতে চেপে যশোর যাওয়া যাবে। গত দুদিন ধরেই ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী প্রধান জেনারেল ম্যানেকশ, বাংলাদেশে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাপ্রধান লে. জে. এ. এ কে নিয়াজীকে একের পর এক বার্তা দিয়ে চলেছেন, নানা সংবাদ মাধ্যমের মারফত এবং এ ছাড়াও ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে লিফলেট ছাড়নো হচ্ছে সারা বাংলাদেশের আকাশ থেকে। এই ঘোষনাগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পন করতে বলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা শহরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী। ঘোষনায় এও বলা হচ্ছে যে, ঢাকা এখন ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের আওতার মধ্যে। পাকিস্তান বাহিনী যদি আত্ম সমর্পণ না করে তাহলে ঢাকা শহরের ওপরে ভারী গোলাবর্ষণ শুরু হবে। সেই সঙ্গে চলবে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অবিরাম বোমা বর্ষণ। এছাড়াও যদি আমাদের দিকের পদাতিক বাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে, তখন ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ বেধে যাবে। স্বাধীনতা একেবারে দোরগোড়ায় এসে গেছে, এটা বুঝতে পারলাম।
এমন সময় ঠিক উল্টো দিক থেকে একটি সেনাবাহিনীর জীপ এল। আমার কাছে এসে জীপটি গতি শ্লথ করল। চালক একজন ভারতীয় সেনা অফিসার। হাসতে হাসতে তিনি আমাকে বললেন, ‘‘এই মাত্র ওয়ারলেসে খবর পেলাম ঢাকায় নিয়াজী আত্মসমর্পন করেছে। Rejoice, You are free”. বলেই জীপটি ভুস করে বেরিয়ে গেল। Your are free! তোমরা স্বাধীন! কথাটি কানে ভাসতে লাগলো। আমি স্থাণুর মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। টেপ রেকর্ডারটা আমার হাত থেকে খসে পড়ে গেল রাস্তার ওপরে। আমি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। আমার দুটি হাতের তালু দিয়ে বাংলার মাটিকে সস্নেহে স্পর্শ করলাম। তারপর আস্তে আস্তে সেই মাটিতে শুয়ে পড়লাম। গড়াতে শুরু করলাম আমার বাংলার মাটিতে। মনে হল এত গাঢ় নীল আকাশ কখনও দেখিনি, এমন টকটকে অস্তগামী সূর্য কখনও দেখিনি যেন আগে। এমন সুখের অপরাহ্ন কখনও আসেনি জীবনে!
১৬ ডিসেম্বর রাতে, যশোর রোডের ধারে একটা দোকানে বসে আমার রাজনৈতিক ধারাভাষ্য রেকর্ড করলাম। ইংরেজি ভাষায় সারা বিশ্বকে জানালাম আমরা স্বাধীন । তারপর সেই টেপটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে করে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে ঐ ধারাভাষ্য প্রচারিত হলো। এরপর যশোর হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের উচ্ছ্বাস এবং পরশ নিয়ে, ফিরে এলাম কলকাতায়। ৯ জানুয়ারি আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে কলকাতা ত্যাগ করলাম। যাত্রা শুরু করেছি ভোর ৬ টায়। কলকাতা থেকে বনগাঁ হয়ে যশোর রোড ধরে যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা হয়ে দর্শনা পৌঁছুতে আমাদের সারাদিন পেরিয়ে গেল। গোয়ালন্দে যখন পৌঁছুলাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়। গোয়লন্দে নদীর অদূরেই ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের একটি ডাক বাংলোয় রাতের মতো আশ্রয় নিলাম। পথে আসতে আসতে আমাদের সঙ্গীরা ঐকতানে একের পর এক গান করছিল। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে আরম্ভ করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ’ধনধান্য পুষ্পভরা’, নজরুলের, ’একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’ হয়ে হেমন্তের গাওয়া ’মা গো ভাবনা কেন’, এই সকল গান। এ জীবনে কখনো বাংলাদেশের এত ভেতরে আসতে পারব কল্পনাও করিনি। জীবনে এই প্রথম দেখছি, এমন মানসিকতা নিয়ে সকল দৃশ্য চেখে চেখে দেখছিলাম। কী আনন্দ, কী আনন্দ! কিছু যখন ফিরে পাওয়ার আশা থাকে না, তখন অকস্মাৎ তা পেলে মানুষ সত্যিই আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠে।
গোয়ালন্দে সন্ধ্যাবেলায় সবাই ক্লান্ত-অবসন্ন, কিন্তু গান চলেছে অবিরাম। কোরাসে গাইছে সবাই, ’…….. ওমা দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দিপ জ্বালিস ঘরে/ তখন খেলা ধুলা সকল ফেলে তোমার কোলে ছুটে আসি……’। শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই ডাক বাংলো ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সেই রাতে আর ঘুমাইনি আমি। অর্ধেক রাত পর্যন্ত বসেছিলাম পদ্মার পাড়ে। এতদিন কাজের দায়িত্ব ছিল মাথার ওপরে, স্বপ্ন ছিল যুদ্ধ জেতার । সেই কাজ শেষ, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। জীবনের একটা অধ্যায়তো শেষ হলো। এখন আবার নতুন পথ চলা শুরু করতে হবে। কী করব ফিরে গিয়ে? জানিনা যে চাকরি ছেড়ে এসেছি, সেটা আছে কি না। ঐ প্রতিষ্ঠানটিই, ইস্ট এশিয়াটিক, আছে কি না, কে বলতে পারে? এক সময় সকল চিন্তা কে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিই। কী হবে অত ভেবে? দেশ স্বাধীন হয়েছে। একটা জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে একজন মানুষের?
পরদিন আমরা ডাকবাংলো থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সকাল ৮টার দিকে একটা নৌকার সাথে রফা হলো। তারা আমাদের সবাইকে পৌঁছে দেবে আরিচা ঘাটে। গোয়ালন্দ থেকে আরিচা পাড়ি দিতে দুঘন্টা লেগেছিল আমাদের। ভারি সুন্দর লেগেছিল ঐ পথটুকু পেরুতে। রোদের আলোয় চক্চক্ করছে নদীর পানি। মাঝে মাঝে জেগে উঠেছে একটি, দুটি সোনালী চর। হঠাৎ হাওয়ায় বালুর ঘুর্ণি উঠছে ঐ চরগুলোর মধ্যখানে। আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলছি অভীষ্ট গন্তব্যের দিকে। আরিচা ঘাটটিও বোমার আঘাতে উড়ে গিয়েছে যুদ্ধের সময়। অতএব ঘাট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে নদীর ধারে আমাদেরকে নামিয়ে দেওয়া হলো। আমরা হেঁটে চলি সামনে। একদিকে নদী, আর অপর দিকে নানা ধরনের শস্যের ক্ষেত। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। সেদিন ফিরতে ফিরতে যা কিছু দেখছিলাম, তা-ই ভালো লাগছিল আমার। এ যেন এক নতুন দেশ আবিষ্কার করছি আজ।
আরিচা থেকে একটি যুৎসই বাস খুঁজে পেতে আমাদের বেশ সমস্যাই হলো। বেলা তিনটার দিকে একটা মুড়ির টিনের মতো বাসে আমরা ৩০ জন এবং সেই সঙ্গে আরো কিছু যাত্রী কোন মতে গাদাগাদি হয়ে বসে ঢাকার পথে রওনা হলাম। আরিচা থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকার দিকে ছুটে চললাম। মানিকগঞ্জের অদূরে তরাঘাটে আমাদেরকে আরো একটি ফেরি পার হতে হল। আবারো বাসের ভেতরে বসে আমরা বাসের ঝাঁকুনির সাথে সাথে সমস্বরে গাইতে লাগলাম বিভিন্ন দেশ-গান।
ঢাকা যতই এগিয়ে এলো কাছাকাছি ততই আমাদের চোখ বাষ্পাকুল হয়ে উঠল। কী রোমাঞ্চ যে লাগছিল তখন, তা ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব! ঢাকায় পৌঁছুলাম আমরা সন্ধ্যা ৬ টায়। বাস এসে থেমেছিল একেবারে নিউমার্কেটের পাশে। ঢাকা শহরে প্রবেশের পর আমরা কেউই অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। আমাদের মধ্যে মেয়েরা অনেকেই একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছে। অবাক হয়ে গেলাম দেখে যে, সন্ধ্যার আধো আলো, আধো অন্ধকারের মধ্যেও ঢাকা শহরের রাস্তা লোকে লোকারণ্য। হঠাৎ মনে পড়ল আজ ১০ জানুয়ারি। আজই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি জেল থেকে লন্ডন এবং দিল্লী হয়ে ফিরে এসেছেন তাঁর প্রিয় বাংলাদেশে। পথে অজস্র নারী পুরুষের সমাগম। সবাই তাদের নেতাকে এক নজর দেখতে নেমে এসেছে শহরের রাস্তায় রাস্তায়। মনে হলো, যখন পরাধীনতার শৃংখল যায় ছিঁড়ে তখন এক নতুন প্রাণে সঞ্জীবিত হয়ে উঠে গণমানুষ। আজ কারো মাঝেই কোন দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। সবাই হাসছে, হাতে হাত ধরে এদিক থেকে সেদিক ঘুরছে ফিরছে। পথে অনেকের হাতে ছোট খাটো আগ্নেয়াস্ত্রও দেখলাম। উস্কখুস্ক চুল, দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে গেছে। পরনে আধা ময়লা কাপড়। বুঝলাম এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, অনেক তরুণ একে অন্যকে সম্ভাষণ জানাচ্ছে ’ জয় বাংলা’ বলে। এই তো আমার বাংলাদেশ!
হঠাৎ এলোমেলো নানা চিন্তা ভীড় করে আসে মনে। এত মানুষের এত ত্যাগ, এত সম্ভ্রমহানি, এত আত্মাহুতি, যার ফসল আমার এই বাংলাদেশ। সব ঠিক থাকবে তো? অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে আমরা এগিয়ে যেতে পারব তো? একটা খালি রিকশায় উঠে বসলাম, আমার গন্তব্য নারিন্দায় যাবার জন্য।
উৎসঃ সেই অরুণোদয় থেকে