আলী যাকের
রামেন্দু দা বলেছেন, ‘আলী যাকেরকে নিয়ে তোমার একটা লেখা চাই ই চাই’। থিয়েটার পত্রিকা আলী যাকের–এর উপর একটা বিশেষ সংখ্যা বের করছে।
আমি কি এখনও প্রস্তুত হতে পেরেছি আলী যাকেরকে নিয়ে লিখতে? কতদিন ধরে ভাবছি লিখব। কিন্তু পারছি না।
জোর করেই ল্যাপটপ–এর সামনে বসলাম। আজ লেখা শুরু করতেই হবে।
বিভিন্ন ফাইল খুলে–খুলে দেখছি । কানাডা থেকে পাঠানো স্মৃতি–গ্রন্থনাটা দেখে চোখজোড়া অজান্তেই ভিজে এলো।
“আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেবনা ভুলিতে”
সত্যি তাই। ওকে মনে পড়ে প্রতিটা মুহূর্ত।
সংসার এক অদ্ভুত জ্ঞাতি–চক্র যা একজন মানুষকে বেঁধে রাখে আরেকজনের সাথে, সুখেদুঃখে।
আলী যাকের–এর সাথে আমার সংসার ছিল অনেক অঙ্গনে । নাটকের সংসার, রুটি–রুজির সংসার আবার “সংসার সংসার”। ৪৫ বছরেরও বেশী পথ চলেছি এক সাথে। শুধু আমি জানি আর যে চলে গেছে, সেই জানে কতোটা সহজ হয়েও কতোটা কঠিন ছিল সে পথ চলা।
ডাবল বেড–এ এখন আমি একা। শেষের এক বছর পাশাপাশি সময় কাটিয়েছি দিনের বেশীর ভাগ সময় জুডে। এমনই একদিন ওকে বললাম, আমাদেরকে নাটকের “মঞ্চ” একটা পরিচিতি দিয়েছে। অথচ দেখো কত মানুষই তো তাদের পরিচয় খুঁজে বেড়ায়। আমরা আমাদের পরিচয় জানি। মানুষ আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে, আর সে স্বীকৃতি মঞ্চের কারণেই। আমাদের চিরকৃত্বজ্ঞ থাকা উচিত “মঞ্চে”-র কাছে। সুন্দরসুন্দর কথা সুন্দর করে বলতো আলী যাকের। তবে স্বীকার করতেই হয় আমি ওর অনেক কথাই তখন মন দিয়ে শুনতাম না। আবার অনেক কথায় দ্বিমতও পোষণ করতাম। একেকবার মনে হতো এসব তো শোনা কথা। কতো আর শুনবো। সেদিন অবশ্য “মঞ্চ”ই আমাদের পরিচয়, এই কথা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো মতানৈক্য তৈরি হয়নি।
আলী যাকের–এর দুটি বিরল গুণ ছিল প্রতিভা এবং দূরদৃষ্টি। যেকটা ক্ষেত্রে ওর পদচারণা, সেসবগুলো ক্ষেত্রেই তার এই দূরদৃষ্টির পদচিহ্ন স্পষ্ট। একটি উদাহরণ, ১৯৭৩–এর ফেব্রুয়ারী মাসে ব্রিটিশ কাউন্সিলে পর পর ৮টি রবিবার সকাল আলী যাকের নির্দেশিত বাদল সারকারের নাটক “বাকি ইতিহাস”-এর বুকিং দেয়ার প্রকারান্তর অর্থ ছিল আমরা, তথা নাগরিক নাট্যা সাম্প্রদায় “নিয়মিত” নাটক করবো। এই অঙ্গীকার নিলাম আমরা সকলেই। আমরা একদল তরুণ সেই শপথেই অটল ছিলাম। শুধু আমাদের দলের নয়, সেসময় দলের বাইরেরও অনেক টগবগে তরুণ–তরুণী এই অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছিলো। দেশে থাকবো, হাজার সুযোগ থাকলেও দেশের বাইরে যাব না ভাগ্যের অন্বেষণে। জীবনানন্দ যেনো আমাদের অন্তরাত্মা হয়ে গেছিলো: “তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও – আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব”–মঞ্চে নাটক করবো।
আমি মাঝেমাঝে ভাবি আলি যাকের স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নাটকে অভিনয় করলো, আরান্যাক–এর হয়ে। মুনির চৌধুরীর লেখা “কবর”। তারপর ও কেনো নাগরিক–এ যোগ দিলো? প্রশ্নটা আমার মনে থেকেই যাবে। কোনো দিন জিজ্ঞেস করা হয়নি তাই প্রশ্নের উত্তরও মেলেনি, কেনো দল বদল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। তাই তো? আজ ওর প্রয়াণের পরে যেনো মনে হচ্ছে এর পেছনে ওর ঐ প্রতিভা এবং দূরদৃষ্টি, দুটোই কাজ করেছিলো।
আলী যাকের অভিনীত ম্যাকবেথ নাটকের একটা স্টিল ছবির দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম সেদিন। লেডি ম্যাকবেথ–এর সাথে। ফেরদৌসি মজুমদার লেডি ম্যাকবেথ। ট্র্যাজিক হিরোর মধ্যে কোনো একটা দুর্বলতা থাকে যাকে বলে হয় tragic flaw। এই flaw-কে protagonist অতিক্রম করতে পারে না, সেই দুর্বলতা তাকে বিয়োগান্তক এবং করুণ পরিণতির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। ম্যাকবেথ–এর দুর্বলতা, সে অন্যের দ্বারা খুব সহজে প্রভাহিত হয়ে পড়ে। নাটকটার প্রথম দৃশ্যে তিন ডাইনী ভবিষ্যৎবাণী করে যে ম্যাকবেথই হবে রাজা। তার সাথে যোগ হয় লেডি ম্যকবেথ–এর উচ্চাভিলাষ। ম্যাকবেথও সেই অতিউচ্চাভিলাষে ভীষণ ভাবে প্রলুব্ধ হয়ে পড়ে বৈ কি। সে নিষ্পাপ শিশুর মতো অথচ রাজা হওয়ার বাসনা তার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে অন্যের প্রভাবে। আবিষ্কার করলাম নতুনভাবে, ছবিটা কি পরিষ্কার ফুটিয়ে তোলে ম্যাকবেথ–এর দ্বন্দ্ব ও অভিব্যাক্তি। অদ্ভুত ভাবে মিশে যেতে পারতো চরিত্রের সাথে, আলী যাকের। তার সে প্রতিভা প্রদর্শিত হয়েছে অনায়াশে একাধিক মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে।
মানুষ আলী যাকের–এর যে কী ভীষণ মনোবল ছিল, তা বলার নয়। ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর সেই মনোবল, শুধু তাকেই নয়, আমরা যারা ওকে ঘিরে থেকেছি, তাদেরকেও অনেক শক্তি যুগিয়েছে। শুধু শেষ এক মাস বোধ হয়, চলে যেতে হবে মনে দানা বেধেছিল, তবে মুখ ফুটে কোনো দিন উচ্চারণ করেনি কথাটা। যখনি নিজের কাছে স্বীকার করবে কথাটা তখনি ও আরও ভেঙ্গে পড়বে এটা ও জানতো, তাই কথাটা উচ্চারিত হয়নি ওর মুখে।
ডাক্তারের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করা হোল। হার্ট বিট কমে আসছিলো। সেই অবস্থায় বাড়িতে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো। প্রথম Dialysis দেয়ার সময় খুব কষ্ট পেয়েছিলো। আমার মেয়ে স্রিয়া ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল “আর Dialysis নেবে বাবা?’ চোখ দুটো বড় করে ইংরেজিতে উত্তর ছিলো: “I can’t even imagine, how you can even ask me this question? If dialysis prolongs my life, of course I will take it”. মৃত্যুর এতো কাছে দাড়িয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চেয়েছিলো, চোখ জুড়ে পৃথিবীটাকে দেখতে চেয়েছিলো, অথচ চলে গেল। চলে যেতে হোল।
আলী যাকের–এর খুব পছন্দের soliloquy একান্ত সংলাপ স্মরণ করতে চাই:
“তাঁর মৃত্যু অন্য কালে হয় হতো ।
তেমন সময় যদি হতো ।
সম্মুখের দিন পরে দিন, পায়ে পায়ে
বড় দীন মিছিলের অগ্রসর দিন থেকে দিনে
বহমান সময়ের শেষ বিন্দু বিফলের দিকে”
বা ওর নিজের কথাই বলিনা কেন?
“দিনের আলো চলে গেলে, সন্ধ্যা আসে, অন্ধকার নামে।
জীবনানন্দ দাশ বলেছেন ‘শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে’
‘সব কোলাহল শেষ হয়’। এর রূপকার্থে যেতে চাই না। রুপক অর্থ তো জীবনের শেষ।
এটাকে অন্য ভাবে দেখলে কেমন হয়?
যে, প্রতিটা সন্ধ্যায় ভাবি পরের দিনের কথা। প্রতি সন্ধ্যায় কাল সকালের কথা?
আবার নতুন জীবনের হাতছানি, আবার পুনরোদ্যমে বেঁচে থাকা” ?
জীবনের শেষ দিন অবধি বেঁচে থাকার যার ইচ্ছা, যার ‘একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশির বিন্দু’-তে এতো আনন্দ, তার কি আরেকটু আয়ু পাওনা ছিল না? সদাহাস্যময় মানুষটা, যার বিলাসিতা গাড়ি করে বাংলাদেশ দেখে বেড়ানো, যার শেকড় রতনপুর, যার সকল রোমাঞ্চ মঞ্চকে ঘির, যে কোলাহলের শেষ দেখতে চায়নি, যে সন্ধ্যার পর সকাল দেখতে চেয়েছে, তারই কি উচিত ছিল না, অধিকার ছিলো না, জীবনকে আরেকটু তারিয়ে–তারিয়ে উপভোগ করা?
যাকের যখন chemo নিয়ে প্রায় বিছানার সাথে মিশে গেছে, আমার মা বলেছিলেন: “আমার ইচ্ছাকরে সম্রাট বাবর–এর মতো বলি, আমার জীবনের বদলে আমার সন্তানকে জীবন দাও। মানুষ নিয়তির স্বীকার। কতো মানুষ আয়ু পায়, আবার কতো মানুষ আয়ু থেকে বঞ্চিত হয়। তবে শতবছরেও যাকেরে–এর পৃথিবীজুড়ে যে আনন্দ, সে আনন্দ ঘুচতো না।
কষ্ট পেয়েছে, অসুখে ভুগেছে, তবে মন ভরে জীবনকে উপভোগ করেছে, এতো টুকুতেই স্বস্তি আমরা যারা রয়ে গেলাম তাদের সবার জন্য।