ট্রাস্টি আলী যাকের – বটবৃক্ষের ছায়া ও আশ্রয়
মফিদুল হক
ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

দীর্ঘদেহী সুদর্শন ব্যক্তি তিনি, গড়পরতা বাঙালির চেয়ে অনেক বড়, আকৃতিতে ও প্রকৃতিতে, দেহের গড়নে ও মনের ধরনে। বিগত ২৭ নভেম্বর জীবনমঞ্চ থেকে তাঁর প্রস্থানের পর নানা মানুষের নানা ধরনের আকুতিতে ফিরে ফিরে আসছে এক উপমা, বটবৃক্ষ, অনেকের জন্য তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের মতো, এর চেয়ে উপযুক্ত আর কেনো উপমা তাঁর ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে পারে না।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্যও স্বভাবগতভাবে তিনি ছিলেন তাই, শুরুরও আগের যে শুরু, সেই সময়ে যেমন, ঠিক তেমনি জীবন-উপান্তে এসেও। এই ভূমিকা তিনি যে সরবে সদম্ভে পালন করেছেন তা নয়, তাঁর ব্যক্তিত্বের সুষমাই তাঁকে সহজাতভাবে এমন অবস্থানে অধিষ্ঠিত করেছিল। ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ সেগুনবাগিচার স্বপ্নসম সাবেকী গৃহে যখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর যাত্রা শুরু করে সে-দিন ছিল আবেগমথিত এক ক্ষণ, তবে তারও প্রায় এক বছর আগে থেকে শুরু হয়েছিল প্রস্তুতি, যখন আমরা ঘনিষ্ঠজনেরা মিলিত হতাম ঘন ঘন, এর ওর বাড়িতে, তখন আলী যাকেরের বাসা হয়ে উঠেছিল নির্ভরতা, প্রেরণা ও আনন্দের উৎস। কোনো দপ্তর ছিল না জাদুঘরের, জাদুঘরই তো তখন ছিল না, ছিল কেবল আকাক্সক্ষা, প্রতিবারের মিলন-সভার পর সেই আকাক্সক্ষা হয়ে ওঠে আরো দৃশ্যমান। গঠিত হয় ৮-সদস্যের ট্রাস্টিবোর্ড, অনেক আলোচনা-বিবেচনার পর। তারপর যখন তেজগাঁও রেজিস্ট্রারের এজলাসে লাল সালু-ঘেরা কাঠের পাটাতনে দাঁড়িয়ে নিজেদের পরিচিতি দাখিল করে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হলো ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্ট’, উদ্যমী চির নবীন আক্কু চৌধুরীকে সদস্য-সচিব করে, তখন মনে হয়েছিল এবার আর পিছু ফেরার কিংবা স্বপ্ন বিসর্জনের সুযোগ নেই। সেই দিন সরকারি দপ্তরে কিংবা পরে এরূপ বিভিন্ন কাজে যখনই কারো দ্বারস্থ হওয়া গেছে সেই দুঃসময়েও মানুষ যেভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তা’ ছিল বিপুল প্রেরণার উৎস। মনে পড়ে সেদিনও তেজগাঁও সরকারি দপ্তরে আলী যাকেরের উপস্থিতি পাল্টে দিয়েছিল পরিবেশ, তারপর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষে কতভাবেই-না তাঁর ব্যক্তিত্ব সুশীতল ছায়া বিস্তার করে চলেছে।

জাদুঘর যখন শুরু করলো স্মারক সংগ্রহের কাজ তখন যাকের ভাই খুঁজে পেতে এনে দিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যুদ্ধ-সাংবাদিক হিসেবে তাঁর পরিচয়-পত্র। এর বাইরে যুদ্ধকালে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে তিনি কখনো বিশেষ কিছু বলেন নি, পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট বামপন্থি বুদ্ধিজীবী লেখক দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সর্বজনশ্রদ্ধেয় চিকিৎসক নৃপেন সেনের সঙ্গে তাঁর ছিল বিশেষ হৃদ্যতা। সেসব কথা কিছু জেনেছি তাঁদের কাছ থেকে, তিনি কখনো কিছু বলেন নি। একবার জাদুঘরের কোনো এক অনুষ্ঠানে সমবেত করা হয়েছিল জহির রায়হানের যুগান্তকারী প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীদের, সেবারই যাকের ভাই জানালেন, চলচ্চিত্রের ইংরেজি ধারাভাষ্য পাঠ করেছিলেন আলমগীর কবির, অনুবাদের কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন তিনি এবং ছবিতে নাটকীয়ভাবে বারবার যে-উচ্চারিত হয় ‘স্টপ, স্টপ’, সেই কণ্ঠটি আলী যাকেরের। এভাবেই তো বহু মানুষের বহু ধরনের ভূমিকা ও অবদানে অপরাজেয় হয়ে উঠেছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ, তা’ কোনো স্বীকৃতি বা আনুষ্ঠানিক সনদ দাবি করে না, বেঁচে থাকে মহাস্রোতের বহমান কল্লোল, সমবেত গান, জাতির অর্কেস্ট্রার মূর্চ্ছনা, যার ব্যাটন একজনের হাতে, যিনি অনেক মহড়া ও অধ্যবসায়ে তৈরি করেছিলেন জাতীয় বাদনদল, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আবার এটাও এক বাস্তব, কোথাও স্বীকৃতি কিংবা নামোল্লেখ না থাকলেও ‘স্টপ জেনোসাইড’ বার্তা পরম তীব্রতা নিয়ে ছবিতে যখন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় তখন আলী যাকেরকে আমরা সেখানে খুঁজে পাই, যে-কণ্ঠ সবাইকে ছাপিয়ে প্রকাশ করে জাতির আকুতি।

মুক্তিযুদ্ধ অব্যাহত ছিল আলী যাকেরের ক্ষেত্রে, নানা দিকে নানাভাবে। মঞ্চে তিনি শিল্পের যে-রূপ ফুটিয়ে তুললেন সেটাও তো মুক্তির চেতনা বিস্তারের আরেক রূপ, তিনি যে সমার্থক হয়ে উঠলেন বিস্মৃত জনসমষ্টির মুক্তিদাতা নেতা নূরুল দীনের সেটাও পেয়েছিল প্রতীকী ব্যঞ্জনা।

আলী যাকেরের উপস্থিতি তাই ছিল আশীর্বাদসম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রয়াসে। কত কথা কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের সঙ্গে। আমার বিশেষভাবে মনে
পড়ে তাঁর সাথে লাকসামের নিভৃতচারী একনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ কর্মী আবদুল আওয়াল সাহেবের বাসায় উপস্থিতি। তিনি সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন অনেক পুরনো কাগজপত্র, সেসব জাদুঘরে দিতে ছিলেন দ্বিধান্বিত, তাঁর আবাসে আলী যাকেরের উপস্থিতি ভাসিয়ে নিয়ে গেল সব দ্বিধা, তিনি সানন্দে আমাদের হাতে তুলে দিলেন এমন সব স্মারক যা’ জাদুঘরকে দান করলো অনন্য সমৃদ্ধি, যার মধ্যে রয়েছে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক-এর হলদেটে হয়ে যাওয়া বিভিন্ন সংখ্যা, যা দেশের আর কোনো লাইব্রেরি বা আর্কাইভে ছিল না।

বিগত বছরগুলোতে যখন তিনি লড়েছেন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে তখন ক্রমে হয়ে পড়ছিলেন অশক্ত, চলাচল হয়েছিল সীমিত, সেই সময়ও মনে পড়ে, তিনি এক বিশেষ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন একক আলোচক হিসেবে। অনেক কর্মসূচির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আসে ফরেন সার্ভিস একাডেমির শিক্ষার্থীরা, যাঁরা কূটনীতিক কাজে সবে যোগ দিয়েছেন। বিগত বছর সেই দলের সদস্যদের জাদুঘর পরিদর্শনের পর তাঁদের উদ্দেশে অসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন আলী যাকের। ফরেন সার্ভিসের নবীন-নবীনাদের উদ্দেশ্যে বলবার জন্য তিনি এসেছিলেন আনুষ্ঠানিক পোশাকে, যে কেতাদুরস্তভাব তাঁকেই মানায়। তবে তার চেয়েও বড় কথা তিনি তাঁর সাবলীল ইংরেজিতে তাঁদের উদ্দেশে বললেন বাংলাদেশের কথা, মুক্তিযুদ্ধ এবং বহু মানুষের আত্মদান, সেই আত্মদানের বিনিময়ে পাওয়া স্বদেশ, তার অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ এবং বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের মহিমা তুলে ধরার ক্ষেত্রে নবীন ক‚টনীতিকের দায়িত্ব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সেই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা কখনো ভুলবেন না আলী যাকেরের সেই অভিভাষণ।

তারপর তো রোগ ক্রমে তাঁকে আরো কাবু করে ফেলে। তিনি দাপ্তরিক কাজও করতে পারেন না, গৃহবন্দি ও অশক্ত, তাঁর যে অমন বাচনভঙ্গি সেটাও হারিয়ে ফেলেছেন, এমন অবস্থায়ও আগস্টের ১২ তারিখ বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা দানের জন্য অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে পরিচয় করিয়ে অনলাইনে সূচনা বক্তব্য প্রদান করলেন তিনি। জাদুঘরের অফিসিয়াল ফেসবুকে রয়ে গেছে তাঁর সেই অংশীদারিত্ব, তিনি নেই তবে তাঁর কাজের রেশ ছড়িয়ে আছে নানাভাবে, আর মিশে আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরতে পরতে।