শিল্পবোধ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা কেন প্রয়োজন
বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকার কোন একটা দৈনিকে একটা চিঠি পড়েছিলাম। চিঠিটির শিরোনাম ছিলো ’বিটিভির রবীন্দ্র-প্রীতি’। প্রসঙ্গ ছিলো নজরুলের গল্প ’ ব্যথার দান’ এর টিভি নাট্যরূপ। নাটকটির শেষে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের সুর বাজানো হয়েছিলো, ’আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করবো নিবেদন’। পত্রলেখিকার অভিযোগ, নজরুলের নাটকে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর কেন বাজানো হলো?
চিঠিটি পড়ে ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম। ওই চিঠির একটি যুতসই জবাবও লিখে পাঠিয়েছিলাম আমি। তাতে বলেছিলাম যে, আমার দুঃখ হয়, যখন দেখি অনেকেই চিন্তা-ভাবনা না করেই, বই-পত্র না ঘেঁটেই, সত্য জানার কোন চেষ্টা না করেই হঠাৎ আজগুবি কথা বলে বসে। নজরুলের ’ব্যথার দান’ এ একটি না, নয়টি রবীন্দ্র সংগীতের উল্লেখ আছে। যখনই তাঁর পাত্র-পাত্রীদের প্রয়োজন পড়েছে আবেগ, একাকীত্ব কি ভালোবাসা বোঝাতে, নজরুল রবীন্দ্র সংগীত ব্যবহার করেছেন। শুধু ’ব্যথার দান’ এই নয়, একাধিক গল্প উপন্যাসে রবীন্দ্র সঙ্গীত ব্যবহার করেছিলেন নজরুল। আমি চিঠিটির মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলাম যে, নজরুল-রবীন্দ্রনাথের বিরোধ কখনও ছিলোনা, যেমনটা কিনা আমরা আমাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য প্রচার করে থাকি। বস্তুতপক্ষে, এঁদের একের প্রতি অন্যের অগাধ শ্রদ্ধাবোধ ছিলো। আমরা কোনো মন্তব্য করার আগে যদি একটু পড়াশোনা করে নেই, তাহলে এই ধরণের অনভিপ্রেত এবং মূর্খ মন্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে তা আমাদের লজ্জার কারণ হবে না। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের একটা বক্তব্য আছে সেটা এরকম- তিনি বলেছিলেন, ”গান যার খুশি সে প্রাণ ভরে গাইতে পারে। গান-তো বনের পাখিও গায়। কিন্তু গান যদি কোন অনুষ্ঠানে বসে গাওয়া হয়, তবে তা কষ্ট করে শিখতে হবে”। আমি বলতে চাই যে, কোনো একটা বিষয় পড়ে কিংবা দেখে আমাদের মনে হতেই পারে যে ব্যাপারটা কেমন যেন একটু লাগছে। মনে হতে পারে যে, কিছু অসঙ্গত কথা বলা হয়েছে কি কাজ করা হয়েছে। কিন্তু কেবল এই সন্দেহেই আমি কলম তুলে নিতে পারি না। আমাকে সমগ্র ব্যাপারটি সম্বন্ধে জানতে হবে। জানার জন্যে প্রয়োজনে পরিশ্রম করতে হবে। তবেই আমি প্রস্তুত হতে পারবো গণমাধ্যমে ছাপাবার জন্য কলম ধরতে।
পত্রিকায় প্রকাশিত আরেকটি চিঠির কথা এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই। চিঠির শিরোনাম ছিলো ’শিন্ডলার্স লিস্ট ও প্রসঙ্গ কথা’। এই চিঠিতে পত্রলেখক স্টিভেন স্পিলবার্গের পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি ’শিন্ডলার্স লিস্ট’-কে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন। তিনি উদাহরণ হিসেবে ফিলিপাইনস্ এ ছবিটি নিষিদ্ধ করার কথা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, গোল্লায় যাক শিল্প, মানুষের রুচি এবং মানসিকতা আগে বিচার করতে হবে। আমি বলতে চাই, যে ছবি বিশ্বের সবচেয়ে প্রার্থিত এবং প্রধানতম চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে নিতে পারে, সেই ছবিতে কেবল রিপু আন্দোলন সৃষ্টি করার জন্যে দৃশ্য কিংবা ঘটনা প্রদর্শন করা হবে না। সে রকম কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে যদি ছবিটি তৈরি করা হতো তাহলে ওই ছবি অ¯কারের জন্যে অনুমোদনই পেতনা।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ওপর একাধিক উৎকৃষ্ট ছবি দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তার মধ্যে একাধিক ছবিতে মানুষের অত্যাচারের এমন দৃশ্য দেখানো হয়েছে যা যুদ্ধবাজ সামরিক আগ্রাসনের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে ভিক্টোরিও ডি সিকার সেই অবিস্মরণীয় ছবি ’টু উইমেন’ এর কথা, যেটা এই ঢাকাতেই দেখেছিলাম কলেজে পড়ার সময়। অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন একজন মা-এর ভ‚মিকায়। এই ছবিটিতে ধর্ষণের দৃশ্য ছিলো। বর্বর নাৎসী বাহিনী মা এবং মেয়েকে ধর্ষণ করার পর ফেলে রেখে যায়। যন্ত্রণায় অপমানে জর্জরিত মা হঠাৎই যেন আবিষ্কার করেন, যে কিশোরী মেয়েকে এতোদিন তিনি মনে করতেন নিতান্ত শিশু, সে যেন এই দূর্ঘটনার মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হয়েছে একজন পূর্ণবয়স্ক নারীতে। ওই কাঁচা বয়সেও চোখ ভিজে এসেছিলো আমার এই দৃশ্য দেখবার সময়। মনে একটুও কুপ্রবৃত্তি জাগেনি। এই ছবি দেখে যদি কারও মনে কুপ্রবৃত্তি জাগে, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে- সেই ব্যক্তির মধ্যেই আসলে গন্ডগোল রয়েছে।
পিনআপের উলঙ্গ ছবি আর ভেনাসের নগ্ন মূর্তি কি মানুষের মনে একই বোধের সঞ্চার করে? পিনআপ হচ্ছে যৌন আবেদনের সুড়সুড়ি আর ভেনাস হচ্ছে শিল্পকর্ম। কেউ যদি হিন্দী ছবি এবং বøু ফিল্মের সাথে গৌতম ঘোষের ছবি ’পদ্মা নদীর মাঝি’, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক এবং আল মাহ্মুদের সাহিত্যকর্মকে একই সারিতে দাঁড় করান তখন তার মেধা সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে, মূর্খ হলেই কেবল এ ধরণের কথা বলা সম্ভব।
অ্যাবর্সাড নাটকের বাস্তবতা
নীরবে চলে গেলেন ইউজিন আয়োনেস্কো। ঠিক যেমন নীরবে চলে যান প্রায় সব নির্জন শিল্পীরা। স্যামুয়েল বেকেট, যাঁ-জেনে,আলবেয়র কাম্যু, জীবনানন্দ দাশ? এঁরা একই পথের পথিক নন, তবুও এঁরা নির্জনের শিল্পীতো বটেই।
১৯৬৫ সনে পেঙ্গুইন প্রকাশিত মার্টিন এসেলিন সম্পাদিত একটি নাটক সংকলন আছে যার শিরোনাম হলো অ্যাবসার্ড ড্রামা। এই সংকলনে চারজন নাট্যকারের চারটি কালজয়ী নাটক স্থান পেয়েছে। ইউজিন আয়োনেস্কোর ’এ্যামিডি এন্ড হাও টু গেট রিড অফ ইট’, আর্থার এ্যাডামভ এর ’প্রফেসর তারান’, ফারনান্দো এ্যারাবেল এর ’দ্য টু এক্সেকিউশনারস’ এবং এডওয়ার্ড এ্যালবির ’দ্য যু স্টোরি’। এই বইটির মাধ্যমেই অ্যাবসার্ড নাট্যকারদের সাথে আমার পরিচয়। তারপর পর্যায়ক্রমে বেকেট, সার্ত্র, কাম্যু, আনুই, কক্তো এবং আরও পরে কবি গ্যুন্টার গ্রাসের নাটকের সঙ্গে। আমরা যখন নিয়মিত নাটকাভিনয় শুরু করি তখন অ্যাবসার্ড নাটক আমাদেরকে ভীষণ অবাক করতো এবং এই বিস্ময়ের কারণে অ্যাবসার্ড নাটকের প্রতি আমাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আমাদের আড্ডায় আমরা তখন প্রায়ই অ্যাবসার্ড নাটক নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তুলতাম। যার ফলে সেই সময় যে অ্যাবসার্ড নাটকই আমরা পেতাম সেটা পড়ে ফেলতাম।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে, যখন বিশ্বমঞ্চে রিয়েলিস্ট নাটকের রাজত্ব বিদ্যমান তখন ইউরোপে বস্তায় করে টাকা নিয়ে গিয়েও একটি আস্ত রুটি কেনা দুষ্কর। যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষেরা কোন কিছু একটা ঘটবার অপেক্ষায় আছে, অলৌকিক একটা কিছু। যার ফলে তাদের প্রতীক্ষার শেষ হতে পারে। তখন সেই অস্থির, আশাহীন মানুষগুলোর মধ্য থেকেই বেরিয়ে এলো কিছু নাট্যকার, যাঁরা ঐ অস্থির সময়ের অলীক বাস্তবসম্মত নাটকের ঝুঁটি ধরে নাড়া দিলেন এবং তাঁদের ঐ দুঃসাহসী নাটক দিয়ে মানুষের কাছে একটি প্রশ্ন তুলে ধরলেন যে, ’দেখো চোখ খুলে, বাস্তবতা কাকে বলে?’ বাস্তবসম্মত নাটকের যা উপাদান তার কিছুই এই নাটকগুলোতে নেই। এই নাটকে কোন সুগঠিত গল্প নেই, কোন নির্দিষ্ট শুরু, মধ্যভাগ বা শেষ নেই। এই নাটক হঠাৎ করেই শুরু হয়। এই নাটকের কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই যাতে দর্শক ধরে নিতে পারে কখন তাদের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে হবে।
অ্যাবসার্ড বা অ‘সংলগ্ন বলে বর্ণিত নাটকের ¯্রষ্টাদের প্রশ্ন হলো, বাস্তবধর্মী নাটক অভিধায় আমরা যে নাটকগুলোকে বোঝাতে চাইছি সেগুলো আসলেই কতটুকু বাস্তব? আবার অসংলগ্ন বলে যে নাটক সংজ্ঞায়িত হচ্ছে সেগুলো বাস্তব থেকে কত দূরে? স্যামুয়েল বেকেটের ’গডোর প্রতীক্ষায়’ যখন মঞ্চে এলো তখন অধিকাংশ নাট্য দর্শক নাসিকা কুঞ্চিত করে বলেছিলেন এটা কি হলো? এটা কি নাটক হলো? এতে গল্প কই? তারা প্রত্যাখ্যান করলেন গডোকে। অথচ ওই নাটকই যখন কারাগারের অন্তরালে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীদেরকে দেখানো হলো, তখন নাটক শেষে মুহূর্মুহূ করতালিতে তারা অভিনন্দন জানালেন ’গডোর প্রতীক্ষায়’কে। কেন? কারন তারা নাটকটিতে এমন কিছু আবিস্কার করলেন যা জীবন ঘনিষ্ঠ। এই যে দিনের পর দিন দুটি মানুষ অপেক্ষায় রয়েছেন একটি পত্র-পুষ্পহীন বৃক্ষের নিচে এই আশায় যে গডো একদিন আসবেন, নিশ্চয়ই আসবেন। সেই গডো তো আর এলেন না! এই অপেক্ষায় থাকতে, থাকতে তারা নিত্য নতুন এবং হাস্যকর সব খেলার উদ্ভাবন করেন। খেলা এগুতে থাকে, উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তাঁদের মনে হয়, এমনকি দর্শক হিসেবে আমাদেরও, যে এই বুঝি কিছু একটা ঘটবে। কিছু একটা! অলৌকিক কিছু! যাতে এই একঘেঁয়ে প্রতীক্ষা শেষ হয়? কিন্তু কিছুই ঘটেনা। সমস্ত আশা-আকাঙ্খা, উত্তেজনা একটি দীর্ঘশ্বাসে পর্যবসিত হয়।
আমরা যদি এই ধরনের সৃষ্টিকে বাস্তবতার মাপকাঠিতে বিশ্লেষণ করি, যেকোন সমাজে, তা সে উন্নত বিশ্বে হোক কি উন্নয়নশীল বিশ্বে, তাহলে কি অহরহ চোখে পড়বে না মানুষের নিরন্তর অসহায়ত্বের স্থির চিত্রগুলো? কথা সাহিত্যিক নাট্যকার আলবেয়ার কাম্যু বিষয়টিকে এইভাবে দেখেছেন যে মানুষের ’জীবন যুদ্ধ’, মানুষের ’জীবনের’ সাথে প্রায় সম্পর্কহীন ভাবেই চলতে থাকে। কাম্যুর ভাষায়, উভয়ের মধ্যে কোন হারমনি নেই। হারমনিবিহীন জীবনই হচ্ছে জীবনের অ্যাবসার্ডিটি। কাম্যু তার ’মিথ অব সিসিফাস’ গ্রন্থে কি সুন্দরভাবে এই অসংলগ্নতাকে তুলে ধরেছেন! সেই যে সিসিফাস একটি অত্যন্ত ভারী পাথর মাথায় করে পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকে এবং পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছানোর আগেই মাথা থেকে খসে পড়ে পাথর। গড়িয়ে নেমে যায় পাহাড়র নিচে। সিসিফাস আবার নিচে নেমে আসে। আবার যাত্রা শুরু করে আবার ঐ একই ঘটনা ঘটে। এই চড়াই-উৎরাই চলতেই থাকে। এর অন্ত নেই। এই যন্ত্রণাই হলো অ্যাবসার্ড নাটকের উপজীব্য। আমরা যারা ছাপোষা মানুষ, জীবনের খেলা সাঙ্গ করে কি কখনও এমন মনে হতে পারে না যে সারা জীবন ঐ সিসিফাসের মতো কেবল পর্বত শৃঙ্গে পাথর বয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টাতেই পার করে দিলাম? আর কোন দিকেইতো তাকানো হলো না! এই উপলব্ধির যন্ত্রণা থেকে এমন সব নাটকের সৃষ্টি যা কল্পনার সুখ-স্বপ্নে বিভোর মানুষকে ধাক্কা মেরে নিষ্ঠুর বাস্তবের একেবারে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
তথাকথিত অ্যাবসার্ড নাটক, যা জীবনের কথা বলছে, তার মঞ্চায়নে কোন দ্বিধার ব্যাপার নেই। এর একটি কারন হলো আমরা যদি আমাদের জীবনের দিকে বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিয়ে তাকাই তাহলে আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই ভীষণ অসংলগ্ন ঠেকবে এবং এই অসংলগ্ন ঘটনাগুলো পরিবেশ বা পরিস্থিতির সৃষ্টি। এমন একটি দৃশ্যের কথা কল্পনা করুন : দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। চারিদিকে অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে। ঢাকার কোন এক বস্তিতে একটি কিশোর এবং তার পৌঢ় পিতার বাস। একদিন পিতার মৃত্যু হলো। পুত্র পিতার মরদেহ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে কবর দেবার জন্যে। রাজপথ দিয়ে অতি ধীরে ধুঁকে ধুঁকে চলছে সে। সেও ক্ষুধায় জরাজীর্ণ। পিতার মৃত্যুশোকে মুহ্যমান। হঠাৎ আশেপাশের কোন খাবারের দোকান থেকে ভেসে আসে উপাদেয় খাবারের সুগন্ধ। কিশোরটি প্রথমে আনমনা হয়ে পড়ে। তারপর, পিতার শবটিকে নামিয়ে রাখে রাস্তায়। মুহূর্তের মধ্যে পিতার মৃত্যু শোক ভুলে যায় সে। খাবারের গন্ধ আত্মহারা করে তাকে। সে ভুলে যায় পিতার শবের কথা। খুঁজতে শুরু করে উপাদেয় খাদ্যের সুগন্ধের উৎস। যদি সে কাছে পিঠে কোথাও ঐ খাদ্যের উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে পায় এবং পিতার শবের কাছে বসে পরম আত্মতৃপ্তিতে গোগ্রাসে গিলতে থাকে সেই খাবার, তাহলে কি পরিস্থিতির বিচারে আমরা এই দৃশ্যটিকে অসংলগ্ন আখ্যা দিতে পারি? তবুও কি এ অসংলগ্ন নয়?
আসলে রিয়েলিজম কথাটির উল্লেখ করে আমরা নির্বিরোধী, সহজ এবং সুখপ্রদ বিষয়গুলোকেই বোঝাই। জীবনের রূঢ় সত্যগুলো যে আপাতঃ অসংলগ্ন ঘটনাতেই বিধৃত তা ভুলে যাই। তাই জীবনের বিবর্ধিত চিত্র দেখলে আঁৎকে উঠি। তাই বলতে হয়, অ্যাবসার্ড নাটক জীবনের গভীরে প্রবেশ করে। মানুষকে ভাবায়। শখের দর্শককে চিন্তাশীল দর্শকে পরিণত করে। অনেকে বলেন যে, অ্যাবসার্ড থিয়েটারের যুগ শেষ হয়ে গেছে। স্বীকার করি যে, ’অ্যাবসার্ড থিয়েটার’ শিরোনামটির যুগ শেষ হয়ে গেছে বটে, কিন্তু যে জীবনবোধ ঐ শিরোনামে সংজ্ঞায়িত নাটকগুলোর মধ্যে পাই, যা আয়োনেস্কো, বেকেট, এ্যারাবেল, এ্যালবী, কাম্যু আমাদের দিয়ে গেছেন, তারই উত্তরসূরী, সামান্য পরিবর্তিতভাবে, আজকের অনেক তরুণতর এবং সফল নাট্যকার। অতএব, জীবন যতদিন আমাদের নির্দেশ করবে জীবন নিয়ে ভাবতে ততদিন গভীর, জীবন ঘনিষ্ঠ নাটক বিশ্বের নাট্য মঞ্চে সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেই যাবে।
নাট্যকর্মীদের নিরন্তর যুদ্ধ
১৯৮৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যু-ইয়র্ক শহরে নাট্য বিষয়ক একটি সেমিনার হচ্ছিলো। সেমিনারটির উদ্যোক্তা ছিলো ন্যু-ইয়র্ক শহরে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট। আলোচনায় প্রধান বক্তা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার স্কুলের অধ্যক্ষ এবং আলোচনায় ছিলেন ন্যু-ইয়র্ক শহরের দু’জন প্রথিতযশা নাট্যনির্দেশক। আমরা বিশ্বের সতেরোটি দেশ থেকে আসা সতেরো জন নাট্যনির্দেশক, সমালোচক ও অভিনেতা ছিলাম শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত। সত্যিকার অর্থে একটি বহুজাতিক দল ছিলাম আমরা। যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, নাইজেরিয়া, ঘানা, মরিশাস, ভারত, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, কলম্বিয়া, মেক্সিকো এসব দেশের প্রতিনিধিরা ছিলো ওই দলে। এর আগে আমরা মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের আমন্ত্রণে চষে বেড়িয়েছি প্রায় গোটা যুক্তরাষ্ট্র। এই সফরের নাম দেওয়া হয়েছিলো অ্যামেরিকান আঞ্চলিক নাট্য সন্দর্শনে আন্তর্জাতিক নাট্য প্রতিনিধি দল। আমরা যেখানেই গেছি একাধিক নাটক দেখেছি। নাটকের স্কুল বা প্রশিক্ষণ দেখেছি। আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছি অথবা অ্যামেরিকান নাট্য ব্যক্তিত্বদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। কথা বলেছি। আমাদের এই সফরের শেষে ছিলো ন্যু-ইয়র্ক। বিদায়ী নৈশভোজের আগে অপরাহ্ণে চলছিলো আলোচনা।
আলোচনার বিষয় ছিলো অ্যামেরিকান রিজিওনাল থিয়েটার। বিশ্বের অন্যান্য নাট্যকেন্দ্রের মতোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নাটকে দুটি ধারা বিদ্যমান। বিশেষ করে বড় বড় শহরগুলোতে। একটি বাণিজ্যিক থিয়েটার এবং অপরটি অবাণিজ্যিক থিয়েটার। প্রথমটিতে, যেমন- ন্যু-ইয়র্কের ব্রডওয়ে ,অগাধ অর্থের সমাগম। সেখানে বণিজ্যিক থিয়েটারের রবরবা। টিকেটের দাম ন্যূনতম ৪০ ডলার। পাওয়া দুষ্কর। আর অবাণিজ্যিক থিয়েটারের আবেদন স্বভাবতই কম। কাজেই ওই থিয়েটার কেবল টিকেট বিক্রির পয়সায় চলেনা। ভর্তুকির প্রয়োজন হয়। এই ভর্তুকি দিতে এগিয়ে আসে পৌরসভা, নগর কাউন্সিল অথবা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এভাবে চলে শিল্পসম্মত নাটকের চর্চা। আবার সব সময় স্পন্সর পাওয়া যায় তা-ও নয়। সেক্ষেত্রে অভিনেতা-নির্দেশকেরা নানারকম বৃত্তিতে নিয়োজিত থাকে দিনের বেলা। সন্ধ্যায় করে নাটক। ওরা বলে অড-জব। এই অড-জব বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। রেস্তোঁরার বাসন ধোয়া থেকে শুরু করে ট্যাক্সি ড্রাইভিং পর্যন্ত। পরিস্থিতিটা অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। কাজেই ওরা যখন বলে ’ন্যু-ইয়র্ক শহরের শতকরা পঁচাশি ভাগ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিনেতা বেকার’ তখন ধরে নিতে হবে যে, ওই সব অভিনেতারা নাটক থেকে তাদের রুটি রুজির ব্যবস্থা করতে পারেছে না। অড-জব করছে বা সোশ্যাল সিকিউরিটির পয়সায় জীবনধারণ করছে।
ওই দিনের অলোচনার বিষয় ছিলো এই সমস্যাটিরই বিস্তারে যাওয়া। অ্যামেরিকার আঞ্চলিক থিয়েটার তখন ভীষণ প্রাণবন্ত। র্যুউভিল এ ফেস্টিভ্যাল, মিলওয়াকিতে রেপারটরি কোম্পানির ফেমিনিস্ট নাটক, সানফ্রান্সিসকোর এথনিক থিয়েটার, এ সমস্ত থিয়েটারে প্রায় বৈপ্লবিক কাজ হচ্ছে অথচ ভর্তুকির অভাবে বেশিদিন চালানো যাচ্ছে না কার্যক্রম। এ রকম একটা অবস্থায় অ্যামেরিকান থিয়েটারের ভবিষ্যত কি? বক্তারা এই বিষয়ে শঙ্কিত। তবে কি অ্যামেরিকায় শিল্পগুণ সমৃদ্ধ থিয়েটারের ভবিষ্যত অন্ধকার?
আলোচনায় যতি পড়লো কফি পানের জন্য। প্রাবন্ধিককে ঘিরে দাঁড়িয়ে অভ্যাগতরা। এরপরেই শুরু হবে প্রশ্নোত্তর পর্ব। আমাদের এক সঙ্গীনি মেক্সিকোর নাট্য নির্দেশক আলিহেন্দ্রা সিয়া। এগিয়ে গেলো প্রাবন্ধিকের কাছে। উত্তেজিত কন্ঠে প্রশ্ন করছে প্রাবন্ধিককে, ”তোমরা অ্যামেরিকান থিয়েটার বলতে কি বোঝাতে চাও? অ্যামেরিকান থিয়েটার বলতে কি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের থিয়েটার বোঝায়? যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কি অ্যামেরিকা নেই? তাহলে মেক্সিকো, চিলি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা অথবা কানাডার থিয়েটারকে কি বলবে তোমরা? নন অ্যামেরিকান থিয়েটার নাকি সাব অ্যামেরিকান থিয়েটার?” আমাদের মূল প্রাবন্ধিক ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহাশয় একবারে নিশ্চুপ। কোন কথা যোগাচ্ছে না ঠোঁটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অ্যামেরিকা অবশ্যই কিন্তু অ্যামেরিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় কারণ অ্যামেরিকায় রয়েছে আরও অনেক দেশ, ভিন্ন ভাষাভাষির মানুষ, বৈচিত্রময় সংস্কৃতি।
আলিহেন্দ্রা কিন্তু থেমে থাকেনি। বলে চলেছে আবেগ তাড়িত হয়ে, ”তোমরা কল্পনা করতে পারো আমাদের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে নাটককে এগুতে হয় কতো প্রতিক‚লতার মধ্যে দিয়ে?” অর্থাভাব তো অছেই। অনেক দেশে আছে স্বৈরাচারের বিধি নিষেধ। এমন সব সরকার অছে অনেক অ্যামেরিকান দেশে যেখানে তোমাদেরই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই দেশের শাসকেরা আমাদের কন্ঠ রুদ্ধ করে রেখেছে। সেখানে নাটক করা আর যুদ্ধ করা এক। এসব তোমরা বুঝবে না প্রাচুর্যের এই দেশে বসে। বুঝবে না যে ’তোমাদের’ অ্যামেরিকান থিয়েটার এর যে সমস্যায় তোমরা চিন্তিত, তার চেয়ে অনেক ভয়াবহ ’আমাদের’ অ্যামেরিকান থিয়েটারের অবস্থা।
ওই দিন নৈশভোজ শেষে আলিহেন্দ্রাকে বলেছিলাম, ”তোমার দুঃখ আমি বুঝি বন্ধু। আমাদেরও বাস এমন একটি দেশে যেখানে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেই শিল্প চর্চা করতে হয় আমাদের।”
আমাদের নাটক এবং কিছু প্রাসঙ্গিক কথা
একটি অভিযোগ নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট আমাদের প্রায়ই শুনতে হয় ইদানিং। শুনতে হয় পত্রপত্রিকার কাছ থেকে। উত্থাপিত হয় প্রশ্নের আকারে। আচ্ছা মঞ্চে নাটকের চর্চা যে স্মিমিত হয়ে এসেছে এর কারণ কি ? এর অর্থ অনেকটা এইরকম দাঁড়ায় যে মঞ্চে নাট্যচর্চা যে স্মিমিত হয়ে এসেছে তা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। এ’বিষয়ে প্রশ্নকর্তা নিঃসন্দেহ এবং তিনি মনে করেন এ বিষয়ে আমারও কোন দ্বিমত নেই। কাজেই এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হলে প্রথমেই যখন আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে বসি যে “না আমি আপনার সাথে একমত হতে পারলাম না”। তখন প্রশ্নকর্তা একটু হক্চকিয়ে যান। কি বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। তারপর তাঁকে যখন বুঝিয়ে বলি যে আমার ধারনা নাট্যচর্চা স্মিমিততো হয়ইনি বরং আরো জংগম হয়েছে, বিচিত্র হয়েছে, বর্ণময় হয়েছে, তখন যে আলোচনাটা বৈচিত্রহীন হবার ভয় ছিলো তা অনেক বেশি জমে ওঠে।
প্রথমেই বলে রাখি নাটক যখন শুরু হ’ল নিয়মিত চর্চিত শিল্প মাধ্যম হিসেবে, সেই তিয়াত্তরের গোড়ায়, যখন বিস্তর হৈ-চৈ হয়েছিলো নাটক নিয়ে। ঢাকার দর্শক হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলো যে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নাটক শুরু হয়ে যাচ্ছে। কুশিলবরা ঝাড়া মুখস্থ সংলাপ বলে যাচ্ছে। হাত-পা নিয়ে কোন সমস্যা হচ্ছে না। দৃশ্যপট বদলের ঝামেলা নেই। দৃশ্য থেকে পরবর্তী দৃশ্যতে যেতে সময় লাগছে পনেরো সেকেন্ড কি আধ মিনিট। এবং সবচেয়ে বড় কথা প্রতি সপ্তাহেই একটি দলের একটি নাটক হচ্ছে । তখন সবার মনে হ’ল ম্যাজিকই হচ্ছে হয়তোবা। আমার স্পষ্ট মনে আছে অনেকেই আমায় বলতেন “দেখালে বটে তোমরা।” আর একথাতো হর হামেশাই বলা হ’ত যে স্বাধীনতার পর এদেশে আর কিছু না হোক নাটক হয়েছে বটে। ঐ সময় পত্রপত্রিকাগুলোও নাটকের প্রশংসায় ছিলো পঞ্চমুখ। বিনোদনমুখি পত্রিকাগুলোতে প্রায়-প্রায়ই প্রচ্ছদ ছাপা হ’ত মঞ্চ নাটকের ওপরে। এখন যা কালে ভদ্রে ঘটে।
এই যে উত্তেজনা ; এই সাধুবাদ ; হৈ – চৈ ; যেমনটি ঘটে পরিবারে যখন প্রথম সন্তানটির আবির্ভাব হয়, নাটকের বেলাতেও তাই হয়েছিলো। কেবল এর জন্যেই মনে হ’ত নাটক বেগবান, নাটক শক্তিধর, নাটক সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটিয়ে দিচ্ছে আমাদের দেশে। নাটক যে তখন একটা কিছু ঘটায়নি সেকথা বলতে চাইছি না। নাটকতো নাটকই ঘটিয়েছে? যা কখনও দেখিনি আমরা পাকিস্তানি আমলে ? তবুও, কাজের সু² বিচারে যদি যাওয়া যায়, বিশ্লেষণ যদি করা হয়, তাহলে বলবো শিল্পকর্ম হিসেবে নাটক নিয়ে হৈ-চৈ অপেক্ষা নিয়মিত নাটকাভিনয়ের সূচনা নিয়েই উত্তেজনা ছিলো বেশি।
ক্রমে যখন নাটক সূচনাপর্ব ছাড়িয়ে প্রথমে গুটি, গুটি পায়ে এবং পরে আর একটু জোর কদমে চলতে লাগলো তখন উত্তেজনা থিতিয়ে আসতে লাগলো। লোকের, বিশেষ করে মিডিয়ার দৃষ্টি অন্যত্র সরে গেলো আস্তে আস্তে। টেলিভিশনের দিকে, ভিডিও’র দিকে ইত্যাদি, প্রভৃতি।
তবুও মঞ্চের নাটকের ক্ষেত্রে কিন্তু অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। সেই সূচনার সময় একটি নাটক পঁচিশবার অভিনীত হলেই মনে হ’ত অনেক হ’ল। এরপর আর দর্শক পাওয়া যাবে না। এখন একাধিক দলের একাধিক নাটক পঞ্চাশ, পঁচাত্তর কি একশবারও অভিনীত হচ্ছে। এর দ্বারা এই প্রমানিত হয় যে দর্শক বেড়েছে। কেননা টিকিট বিক্রি না হলে কেউতো গাঁটের পয়সা খরচ করে নাটক মঞ্চায়ন করবে না।
সত্তরের শুরুতে, যেমন আগে বলেছি, নাটকের অন্তর্নিহিত শিল্পগুন অপেক্ষা আমরা বেশি নজর দিতাম নাটকের সুচারু উপস্থাপনায়, শৃংখলায়। এখন কেবল পরিবেশনায় অথবা আংগিকেই সীমাবদ্ধ থাকছেনা নাটক। বিষয়বস্তুতেও বৈচিত্র আসছে ক্রমাগত। স্বদেশে যেমন রচিত হচ্ছে শিল্পগুন সমৃদ্ধ উঁচু স্তরের নাটক তেমনি শেক্সপীয়র, ইবসেন, চেকভ ব্রেশট, বেকেট-এর নাটকেরও সফল মঞ্চায়ন হচ্ছে আমাদের মঞ্চে।
আমি জানি যে নাটককে সম্পূর্ণ পেশাদার একটি মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আরও অনেক পথ আমাদের পেরুতে হবে। তবে সঠিক পথে, সঠিক দিকে যে আমরা পথ চলছি সে বিষয়ে নগন্য একজন নাট্য কর্মী হিসেবে আমার কোন সন্দেহ নেই। আমার হৃদযের গভীরে আমি অনুভব করি যে, আমাদের ঢাকার মঞ্চে অভিনয় করার সঙ্গে সৎ এবং একটি পবিত্র কাজ করার যোগ আছে যেন কোথায়!